Follow Us:
বৈশাখ সংখ্যা (Publish Date: 08 May 2024)

উপকথার আড়াল থেকে উঁকি দেওয়া রাষ্ট্রের জন্মবৃত্তান্ত

1592641633.jpg?v=1370024657

পুরুষোত্তম সিংহ

‘..সময়ের বুকে ক্ষত জমে আছে /.. কিছু দেখি কিছু দেখতে পাই না ...’

       ভারতের জনজীবনের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ট্র্যাজিক ঘটনা পঞ্চাশের মন্বন্তর ও দেশভাগ। পঞ্চাশের মন্বান্তরের জন্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে নয় কিছুটা দায় দেওয়া গেল কিন্তু দেশভাগ ? রাষ্ট্রের ষড়যন্ত্রে বলি হল মানুষ। হ্যাঁ যুপকাষ্ঠে রেখে বলিই, নইলে ভিত্তিহীন ভাবে দেশ ছাড়তে হল কেন ? দেশভাগে সাধারণ মানুষের কোন বয়ান শোনা হল না, সাধারণ মানুষের কোন মত নেওয়া হল না। সাধারণ মানুষের মূল্য রাষ্ট্রের কাছে কতটুকু ? বোধহয় শূন্য ! উদ্বাস্তুর দল ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। বাঙালি এ ইতিহাসকে তেমন ভাবে মনে রাখল না, লিপিবদ্ধের প্রয়োজন মনে করল না। ক্ষত ইতিহাস মনে রাখায় বেদনা থাকে। স্মৃতি আনন্দমধুর হওয়া প্রয়োজন। রাষ্ট্র কোন ডকুমেন্ট রাখল না এ ট্র্যাজিক বেদনার। কেন রাখল না ? আসলে ভুলে যেতে চাইলো এ ইতিহাস। বাঙালি ইতিহাস ভুলতে বড় ভালোবাসে। এই ভ্রান্তি রুখে দিতে রাষ্ট্র নতুন সিস্টেম চালু করে। পরীক্ষা ব্যবস্থার জাদুতে মাধ্যমিকে ইতিহাসে একশতে একশ পাওয়া যায়। রেজাল্টের তথ্য জানায় আমরা ইতিহাস ভুলিনি কিন্তু ইতিহাস বইয়ের পৃষ্ঠায় কোন তথ্য থাকে না। তথ্য বড় ঝামেলা সৃষ্টি করে। দেশভাগে বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে যে নতুন স্বপ্নের জন্ম হল তা সামনে রেখেই এগিয়ে চলল মানুষ। বলা ভালো এ যাত্রা আরও এক শূন্যের দিকে। ভিটেমাটি হারিয়ে তথাকথিত নতুন দেশে বসতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে চলল ‘মিছিলের মুখ’। একবার ভিটেমাটি হারালে আর কি পাওয়া সম্ভব ? অবধারিত উত্তর আসবে না ! সারাজীবন যন্ত্রণাদগ্ধ হতে হল উদ্বাস্তু মানুষদের। কলোনি গড়ে উঠল ঠিকই কিন্তু সুখ কোথায় ? সুখের থেকে অসুখই বোধহয় বেশি। কলোনিতে ভদ্র বাঙালির পেটে সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে খিস্তির জন্ম হল। উদ্বাস্তু কলোনির ভদ্র বাঙালি  এপারের মধ্যবিত্ত এলিট বাঙালির কাছে অভদ্র হয়ে গেল। ‘শান্তি’ নামক শব্দকে ব্যঙ্গ করতেই বুঝি পাকিস্তানের জন্ম হল ! হিন্দু মানুষ যেন আর সে দেশের অধিবাসী নয় এমন ভাবতে বাধ্য করা হল। মুসলিম নিজের স্বভূমি ভাবতে শুরু করল পাকিস্তানকে। এ কোন মুসলিম ? ধর্মীয় মৌলবাদী মুসলিম, বাঙালি মুসলিম নয়। ধর্মের জয় যুগে যুগে-একথা বেরঙিন হতে শুরু করল আধুনিক যুগে। যেখানেই ধর্ম সেখানেই অপশাসনের কায়েমিতন্ত্র মাথা তুলে দাঁড়াল।

         দেশভাগের কিছু ইতিহাস লেখা হল, সাহিত্যও লেখা হল। আবার দেশভাগকে পটভূমি করে আলগা প্রেম রোমান্সের বিনোদনমূলক আখ্যানও গড়ে উঠল। কেনইবা লিখবেন না ? মেজর পাঠক যা চায় হাউস তো তাই ছাপতে রাজি। সাহিত্য হয়ে উঠল জনরুচির মাধ্যম। সময়ের ক্ষত অনেকেই দেখলেন না। আবার কেউ কেউ দেখেও চোখ বুঝে রইলেন। কেন বুঝে রইলেন তা আমরা জানি না। চেতন সত্তায় দেশভাগের ক্ষত তেমন করে কেন নাড়া দিল না সেসব উত্তর নেই। নিরুত্তরই বুঝি এর বড় উত্তর। কেউ কেউ উত্তর না দিয়ে পারলেন না, না লিখে পারলেন না। সময়ের ক্ষতকে অস্বীকার করবেন কীভাবে ? কিছু লেখক নিজের মতো করে লেখা শুরু করলেন। পীযূষ ভট্টাচার্যরা বারবার আখ্যান ভেঙে দিয়ে এগিয়ে চললেন। সমান্তরাল কাহিনি অপেক্ষা উপন্যাসকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যান। সমস্ত বয়ানই পৌঁছতে চায় শিল্পের পর্যায়ে। চাইলেই তো আর পৌঁছনো সম্ভব নয়। আসলে টেক্সট এর বয়ান, কারুকার্য, আখ্যান দ্বারাই শিল্পরূপে পৌঁছতে হয়। পীযূষ ভট্টাচার্যের যেকোন আখ্যানই উপন্যাস শিল্পরূপের দাবি করে। এ দাবি সংগত। দীর্ঘদিন ধরেই উপন্যাসের ফর্ম ভেঙে চলেছেন। দেশভাগকে পটভূমি করে লিখেছেন ‘নিরুদ্দেশের উপকথা’ উপন্যাস। দেশভাগ তো মানুষকে নিরুদ্দেশই করেছিল। উপকথার রাজা-রানি যেমন হারিয়ে যায় দেশভাগে প্রিয়জন বিচ্ছেদ ঘটে গেল। উপকথার রাজা-রানির মিলন ঘটলেও দেশভাগ বিচ্ছেদে প্রিয়জনের মিলন ঘটেনি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। কেনইবা ঘটবে এ উপকথা যে ব্যক্তি লেখকের লেখা।

         উপন্যাসের শুরু রূপকথার স্টাইলে-‘বহুদিন পর একদিন’। মানুষ বর্তমান থেকে অতীতে ফেরে। আর অতীত নিয়েই গড়ে ওঠে স্মৃতি। সব স্মৃতি মনে থাকে না। মস্তিষ্ক মনে রাখতে দেয় না। স্মৃতি বড় মায়াময়। বলা ভালো মধুময়। মায়াময় জগতের সন্ধান দিতে লেখক পাঠককে সঙ্গী করেন। রূপকথা শৈশবকে কেন্দ্র করে জড়িয়ে থাকে। রূপকথা অর্ধসত্য-অর্ধ মিথ্যা। এ জগতের সন্ধান কেবল শিশুদেরই দেওয়া যায়। সংসারে সরলাবালারা থেকে যায়। আখ্যানের প্রয়োজনে থেকে যেতে হয়। নইলে রূপকথা গড়বে কে ? বৃদ্ধ দাদু ঠাকুমার কিসের অস্তিত্ব ? তবে আজকের রূপকথায় অবাস্তব এলেই বাস্তব এসে ভেঙে যায়। লেখককে আনতে হয় বাস্তুসাপের প্রসঙ্গ। যখনই রূপকথায় ডুব দিতে যান সাপ এসে ভেঙে দেয়। সত্য-অর্ধসত্যের মাঝে আখ্যান দোল খায়। বলা ভালো লেখক কাহিনিকে ঝুলিয়ে রাখেন।ইন্দুবালা হেঁটে চলেছে। এটা একটা জার্নি। অনুসরণ করে হেঁটে চলেছে। কিন্তু বিভ্রান্তি ঘটে। সব অনুসরণই সত্য হতে পারে না। সে সরলাবালাকে অনুসরণ করে হাঁটছে। আসলে সে শূন্যকে অনুসরণ করে হাঁটছে। সে শূন্য মিশে গেছে অদৃশ্যলোকে। নৌকা উজানে ফিরে যাচ্ছে। কাহিনির উলটো স্রোত বয়। অবাস্তবের মধ্য থেকে তিনি বাস্তবে ডুব দেন। রহস্য খোঁজেন। রহস্য নির্মাণ করেন। সেই রহস্যের মধ্যেই অতিবাস্তবের সন্ধান দেন। এ রহস্য বড় হয়ে ওঠে বাক্যের অনবদ্য বুননে। প্রথমে বিভ্রম, পরে বিভ্রম থেকে পাঠককে মুক্তি দেন। দেশহারা ইন্দুবালা। আখ্যান পৌঁছে যায় নদীতীরে। সে দেশ খুঁজছে। অন্তঃপুরের মেয়ে দেশের কী জানে ? দেশের মানচিত্র বিষয়ে কোন জ্ঞান নেই। চেনে শুধু নদী। আখ্যান ইন্দুবালা থেকে সরলাসুন্দরীতে পৌঁছায়। আত্রেয়ী নদীতে আছে ‘রাইখোর’ মাছ। আছে লোকাচার বিশ্বাস। সরলা স্বামীর নাম মাছের নামেই ডাকে। হিন্দু সংস্কার স্বামীর নাম উচ্চারণ করেনা স্ত্রী। নদীর ধারের মহিলাদের নদীতে স্নান যেন এক অভিযান। শাশুড়ি পুত্রবধু স্নানে যায়। স্নানে গিয়ে ইন্দুবালা হারিয়ে যায়। এমনকি সরলাবালারাও জলে জ্ঞান হারায়। মানুষগুলি নিরুদ্দেশ হয়ে যাচ্ছে। বলা ভালো লেখক নিরুদ্দেশ করে দিচ্ছেন। আসলে তিনি তো আখ্যানটি গড়ে তুলছেন, আখ্যানের প্রেক্ষাপট নির্মাণ করছেন।

 

বাস্তব বড় কঠিন হরিদাসী / ধর্ম বড় সয় না ...

        লেখক বিভ্রমের বাস্তব  আবিষ্কার করতে করতে এগিয়ে চলেন। বাস্তব-অবাস্তব, চেতন-অবচেতনের মধ্য দিয়ে আখ্যান এগিয়ে যায়। ইন্দুবালাকে খুঁজতে সরলাসুন্দরী নিজেই জলে নামতে চায়। বাধা দিলেই অজ্ঞান হয়ে যায়। রূপকথা কোথা থেকে শুরু হবে ? নির্দিষ্ট পয়েন্ট অফ ভিউ চাই। ফলে প্রথম বাক্যেই এক রহস্যাবরণ গড়ে তোলা প্রয়োজন। যেন শ্রোতা প্রশ্ন না তোলে। ভবতোষ ভাদুড়ি চলেছেন নদীতে সরলাবালার খোঁজে। লেখকের অনবদ্য বয়ন কৌশল। নিছক কাহিনি নয় উদ্ভটের কাহিনি। এ কাহিনি সরলরেখায় নয় জটিল রেখায়। আছে কাহিনির ঘূর্ণন।কেন্দ্র থেকে বিচ্ছুরিত হয়ে ছড়িয়ে যাওয়া, আবার কেন্দ্রে প্রত্যাবর্তন। উচ্ছিষ্ট খাদ্য নিয়ে কাকেদের লড়াই। বলতে পারি শ্রেণির লড়াই। রাষ্ট্রের উচ্ছিষ্ট অংশ কাকেরা খাচ্ছে। ভক্ষণে লড়াই আছে তবে বিচ্ছেদ ঘটলেই আবার মিলনের বার্তা। বিত্তবান ভবতোষ ভাদুড়ি কাকেদের লড়াই দেখেন। শ্রেণিহীনের যাপনচিত্র শ্রেণিভোক্তা উপভোগ করেন। চেতন মনে কোনো সাড়া নেই। সবই অসার। শুধু বোঝেন টাকা। বিত্তবানের সেদিকে তীব্র নজর থাকে। উপন্যাসের সূচনা বিন্দু দেশভাগ পূর্ববর্তী সময়ে। দৌলত মিঞা অনবরত পতাকা বানিয়ে চলেছেন। পাবলিকের মনে সন্দেহ দানা বাধতে থাকে। মেজরিটি কে ? হিন্দু না মুসলিম। মেজরিটির সত্যই শেষ সত্য। রাষ্ট্রের বয়ান মিথ্যে করে দিতে পারে মেজরিটি। তবে এ তথ্য পৌঁছতে হবে র‍্যাডক্লিফ সাহেবের কাছে। তিনি ঘরে বসে মানচিত্র আঁকেন। মানচিত্রের ওপর জলবিন্দু দিয়ে ফুট নোট করেন। অদ্ভুত বয়ান কৌশলে আখ্যানে ঘোর সৃষ্টি হয়। পাঠককে সে রহস্য উদ্ধার করে এগিয়ে যেতে হয়। পড়তে পড়তে মনে হয় অতিবাস্তব কেটে বাস্তবে প্রবেশ করছে। শেষে আবার দেখি সবাই অচেতন। আসলে চরিত্রের চেতনসত্তা প্রকাশ পায়। ব্যক্তি যা ভাবছে বয়ানে তা বাস্তব হয়ে ওঠে। কিন্তু শেষে দেখা যায় সব অবাস্তব। তবে ব্যক্তির ভাবাটা অবাস্তব নয়। সেখানে লুকিয়ে আছে ঘোর বাস্তব। পাকিস্তানের জন্মের আগেই নান্নু মিঞায় অত্যাচার শুরু হয়ে যায়। সে অত্যাচারের বয়ান স্পষ্ট করতে চান লেখক। তবে তা অর্ধসত্য। পাঠক উপলব্ধিতে তা স্পষ্ট করবেন। নান্নু মিঞার ছিল বহু রক্ষিতা। একের পর নারী ধর্ষণ করে চলেছেন। তবে পেটে সন্তান এলে তিনি ধর্ম রক্ষা করান। বেগারখাটা মুনিসের সঙ্গে বিবাহ দিয়ে মনে শান্তি পান। তবে নারী ভোগ বিবাহের পরেও চলে। বিবাহ দিয়ে নিজের উত্তরাধিকারী থেকে বঞ্চিত করেন। সন্তান যেন আবার নান্নু মিঞার পুত্র বলে দাবি না করে সেদিকেও নজর থাকে। এই ঔপনিবেশিকতা সেদিনও চলছিল। নান্নু মিঞারা জমিদার পর্বের শেষ উত্তরাধিকারী। তাঁর নজরে পড়লে মুশকিল। তিনি বাজপাখির মতো সুতীব্র নয়নে সুন্দরী নারীদের খোঁজ রাখেন। যেমন পড়েছিল দৌলত মিঞার মাতা। এসব ইতিবৃত্ত দৌলত মিঞার স্মৃতিতে ভেসে চলে। অনবরত পতাকা বানানো চলছে। মেজরিটির অংশ হিসেবে মুসলিমরা কান্তনগড়ে পাকিস্তানের সূচনা করতে চাইছে। তার প্রাক প্রস্তুতি চলছে।

       সুরজমালের ছিল কাপড়ের দোকান। হিন্দুরা ক্রমেই ভয় পেতে শুরু করে। মুসলিমরা নিজেদের আধিপত্য উপলব্ধি করতে শুরু করে। আদালতে যাওয়ার আগে লোকাচার পালন করা হয়। কপালে আতপচালের অবস্থানই জানিয়ে দেয় কেসের ভাগ্য। বসন্ত সরকাররা মার্ডার হয়ে যায় বাহাউদ্দিন দ্বারা। শুরু হয়ে যায় হিন্দু তোষণ। একটি দেশ একটি জাতির হয়ে যাচ্ছে। বাঙালি হিন্দু ক্রমেই বিপর্যয়ের মুখে এগিয়ে যায়। আছে লোকাচার সর্বস্ব জীবন -

‘’সুরজমলের এতদিন জুরিগিরি করে এসেছে অদ্ভুত এক ধর্মীয় উপাচারে। কে না জানে যে দিন আদালতে রায়দানের জন্য জুরিদের মতামত নেওয়া হবে সে দিন সে গদিতে বসবে না। তার পরিবর্তে ছেলে সামলাবে। সকাল থেকেই সে ঠাকুরঘরে, পুজো শেষে যখন বেরিয়ে আসবে কপালে সিঁদুরের সঙ্গে লাল চন্দন মিশিয়ে একটি ফোঁটা, ফোঁটায় পাঁচটি আতপচালের অবস্থান। যেন কোনো অলৌকিক পদ্ধতিতে আতপচালগুলো নিজেদের অবস্থান ঠিক করে নিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে এক সময়। যার বোঝার সে বোঝে। সুরজমল তারপর আয়নার সামনে দাঁড়াবে। আতপচাল যদি বাঁদিকে হেলে থাকে তবে বুঝে নিতে হবে যাবজ্জীবন, আতপচাল উর্দ্ধমুখী হলে ফাঁসি, ডানদিকে অল্পস্বল্প শাস্তি, নিম্নমুখী হলে-নিম্ন অর্থে এখানে স্বস্থানে-অর্থাৎ যেখানেই ছিল সেখানেই থাকবে-বেকসুর খালাস।‘’(নিরুদ্দেশের উপকথা, আখ্যান সমগ্র ১, তৃতীয় পরিসর, প্রথম প্রকাশ, জানুয়ারি ২০২০, পৃ. ২৫০ )

 লোকাচার বিশ্বাসই ভাগ্য নিয়ন্তা। কপালই সত্য। ভাগ্যনিয়ন্ত্রক হিসেবে নিয়তিতে বিশ্বাস। বসন্ত সরকারের মামলায় বাহাউদ্দিনের ফাঁসির নির্দেশ হয়ে যায়। সুরজমাল জজসাহেবকেও দেবতার নাম বলেনি। সে দেবতার ভাগ দিতে চায় না। দিনাজপুরকে বলা হয়েছে ‘কনসিডারেবল ব্লক’। মানুষের ভাগ্য ঝুলে থাকে র‍্যাডক্লিফে। আপাত চাল জানান দেয় মানুষের ভাগ্য। দেশভাগ যেন বাঙালির ভাগ্য বিপর্যয়। আর তা মিলিয়ে যায় লোকাচারে। তাও আবার সাধারণ লোকাচার নয়। অন্য লেখক থেকে পীযূষ ভট্টাচার্য এখানেই পৃথক হয়ে যায়। সত্য-অর্ধসত্যের মধ্যে কাহিনি এগিয়ে যায়। বসন্ত সরকারের মাহিন্দার ছিল বহাউদ্দিন। জমি দখল করতে চেয়েছিল। জমি নিয়ে বিবাদ না মেটায় খুন করতে বাধ্য হয়। পেশিশক্তিই বড় হাতিয়ার। মুসলিম বলেই সে সাহস আরও দ্রুত ধাবিত হয়। চারিদিকে চলে দখলতন্ত্র।

রাজনীতি ধর্ম একে অপরের জেরক্স কপি / স্পষ্ট-অস্পষ্টের মাঝে কালি খায় মানুষ

      কংগ্রেসী আমল। ১৯৪২ এর আন্দোলনে কংগ্রেস এগিয়েই ছিল। তবুও মুসলিমরা ছেড়ে দেয় না। অফিসে অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয়। হিন্দুরাও পিছিয়ে যায়নি। কিন্তু জোর যার মুল্লুক তার নীতিতে মুসলিমরা এগিয়ে যায়। দিনাজপুরের কান্তনগরকে পাকিস্তান ভাবতে শুরু করে। এই আধিপত্যের শক্তি কোথা থেকে এল ? ভয়ে বিনোদবিহারী জমি দান করেছেন মুসলিম মসজিদের জন্য। এইখানে এসে বাংলা আখ্যান ভেঙে গেল। মেকি বাস্তবের যে অবতারণা লেখকরা করেন তা পীযূষ ভট্টাচার্য ভেঙে দেন। কেউ সম্পত্তি ছাড়তে চায়না, সে পরিমাণে যতই হোক। যতক্ষণ না বাধ্য হচ্ছেন, তা ছাড়ে না। এই ছাড়া না ছাড়ার বৃত্তান্তকে আলগা রোমান্স দিয়ে কেউ কেউ ভরিয়ে দেন। বিনোদবিহারীদের মতো হিন্দুদের ভরসা র‍্যাডক্লিফ। সে নিজেই এক ভাগ্য নিয়ন্ত্রক। ভারতের ভাগ্য বিধাতা। এই দুঃস্বপ্নের পরিস্থিতিতে হারিয়ে গেছে ইন্দুবালা। হারিয়ে যাওয়ার বৃত্তান্ত শুরু করে লেখক প্রকৃত বৃত্তান্তে যান। দেশভাগের পূর্ব মুসলিম অত্যাচার বড় হয়ে ওঠে। হিন্দু অস্তিত্বের সংকটে ভোগে।

        এ যেন হিন্দুর নিয়তি। নিয়তির অপর নাম যম। জীবনানন্দের নায়ক সব থাকা সত্ত্বেও মৃত্যুঘরে এগিয়ে গিয়েছিল। আসলে বুঝি যম ডাক দিয়েছিল ! বিনোদবিহারী সরলাসুন্দরীকে জীবিত করেছে জোয়ান দিয়ে। সরলা চেতন পেয়েই ইন্দুবালার কথা বলে। তবে ইন্দুবালাকে কখনই পাওয়া যায়নি। নদীতে জল নেমে গেছে। ভবতোষ ভাদুড়ি এ কাহিনি বলেন। কিন্তু অতীতে ডুব দিলেই বর্তমান এসে উপস্থিত হয়। সব চেতনা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। হাজার বছর আগের উপকথা আর শত বছর আগের উপকথা এক হবে না। লেখক যে উপকথা লিখতে চান তা ভিন্ন। আসলে প্রখর বাস্তবকে লিপিবদ্ধ করতে তিনি একটু আড়াল খোঁজেন। এ আড়ালেই দেশভাগের নির্মম সত্যকে জানান দিয়ে যান। ভবতোষের পূর্বপুরুষ কিশোর দেবী কালিকা হয়ে গিয়েছিল। মূর্তিহীন দেবী। স্ত্রীর খোঁজ করে ভবতোষ বাড়ি ফেরার সময় একদল শুয়োর দেখেন। তা যেন তাকে রূপকথার জগতে নিয়ে যায়। যখনই রূপকথায় প্রবেশ করেন তখনই দেখেন মিছিল ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। মুসলিমদের কাছে শুয়োর হারাম। মিছিল থেমে গেছে। বাস্তব কাহিনি থেকে তিনি যখনই রূপকথার জগতে প্রবেশ করতে চান তখনই এক ঘোর বাস্তব এসে রোমান্সকে ভেঙে দেয়। বাস্তব থেকে রূপকথায়, কখনও রূপকথা থেকে বাস্তবে প্রবেশ করতে চান। কিন্তু পারেন কি ? বলা ভালো লেখক প্রবেশ করতে দেন না। তিনি শক্তভাবে কাহিনি ও চরিত্রকে ধরে রাখেন। বাস্তব-অবাস্তবের মধ্যে কাহিনি দোল খায়, সঙ্গে জুড়ে দেন লোকবিশ্বাস ও মিথের প্রসঙ্গ। বয়ানে পাই –

‘’ঠিক বাজারের মাঝখানে দলটা এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। কেননা এক দঙ্গল শুয়োর চরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে জমাদার। ভবতোষ ভাদুড়ির চতুর্দিকের এত বিভ্রান্তকর অবস্থানে শুয়োরের দঙ্গলের মধ্যেই একটি নির্দিষ্ট শুয়োর মাতৃত্বের গাঢ় অনুভব নিয়ে ধীর গতিতে হেঁটে রাস্তা পার হচ্ছে। হেঁটে চলবার প্রতিটি ছন্দই যেন রূপকথার দরজা। ভবতোষ ভাদুড়ি কখন যে রূপকথার দরজা দিয়ে নিজে প্রবেশ করে গেছেন জানেন না, সেখানে খুঁজতে থাকেন ইন্দুকে।

 কিন্তু শুয়োরের দঙ্গল পার হতেই দেখেন একটা মিছিল দাঁড়িয়ে। মিছিল চিৎকার করে ওঠে-‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ...’’( তদেব, পৃ. ২৫৪ )

     করুণা মোক্তারের ছেলে কিশোর মুসলিম পেয়ার আলি হয়ে গেছে। ধারণা মুসলিম হওয়া ছাড়া কান্তনগরে থাকা যাবে না। মুখে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। নূরজাহান ছিল বিনোদবিহারীর বাঁধা মেয়েমানুষ। সকলের ধারণা নূরজাহানকে ভালোবেসে সে মসজিদ করে দিয়েছে। সকলে ভাবে বিনোদবিহারী ‘সেকুলারিজম’। কিন্তু তথ্য বলে ভিন্ন কথা। মসজিদ করে দিতে বাধ্য হয়েছে মুসলিম শোষণে। ধর্মই ধর্মহীনতার জন্ম দিয়েছে। ধর্মই দেশহীন করে তোলে। লীগের প্রার্থী তখনও জেতেনি। ভবতোষ অনুমান করেছিল পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু হল বিপরীত। ভবিতব্যই ভবিষ্যৎ নয়। ভবিষ্যৎ বিধাতাও তা জানেন না।ভবিষ্যৎ নির্মাণ করে মানুষ। তার বড় সোপান ধর্ম। শ্রেণির ক্ষমতা ধর্মকে কাজে লাগাতে চায়। অনুভবের একটি নির্দিষ্ট সীমারেখা আছে। সেই সীমারেখার মধ্যেই ব্যক্তির জীবনভাবনা আলোড়িত হয়। ভিখারি কখনও তাজমহলের স্বপ্ন দেখতে পারে না। তা বড় অবাস্তব। স্বাধীনতা আর বেশি দূরে নয়। শুরু হয়ে গেছে দাঙ্গা। দাঙ্গা মানেই নারী ভোগ। নারী মাংস বড় মধুর। ইন্দুর শরীরে মাছের গন্ধ। গন্ধের আড়ালে সে নিজেকে রক্ষা করতে চায়। পুরুষ শাসিত সমাজ থেকে রক্ষা পাওয়া  কি খুব সহজ ? প্রতি পদক্ষেপে চলে লড়াই। ইন্দুর মৃত্যুকামনা বড় হয়ে ওঠে। জীবিত অবস্থায় মৃত্যুযন্ত্রণা উপভোগ করতে হয়। নদীর ধারে অবস্থান হয়েও পরিত্রাণ নেই। তবে একটা পথ থাকে-যখন তখন নদীতে ডুব দেওয়া যায়। আছে আখ্যানের অনবদ্য টেলিং। নারীর প্রধান শ্রত্রু পুরুষ। অন্তত দাঙ্গাকালীন সময়ে তো বটেই। ইন্দু নিজেকে রক্ষা করে ধান গাছের আড়ালে।

বাঁচা মরা উভয়ই সমান , নারী-পুরুষ নিছক সংখ্যা

    মানুষ প্রকৃতি সর্বস্ব। যদিও প্রকৃতি নিধন উৎসবে মানুষের বড় আনন্দ। মানুষ অবস্থার দাস। বিপদে নিজেকে ঠিক গুটিয়ে নিতে পারে। কেন্নোর কাছে এবিষয়ে মানুষ শিক্ষা নেয়, কচ্ছপকে আদর্শ মনে করে। আত্মরক্ষার সমস্ত হাতিয়ার নিজের মধ্যেই লুকিয়ে রাখে। জন্মের পর থেকেই শুরু হয় যুদ্ধ। ফলে নিজেকে যেকোন মুহূর্তে আত্মরক্ষা করতে হয়। পাকিস্তান ধ্বনি কানে আসে। কানে যন্ত্রণা হয়। মিলিটারির যাত্রাধ্বনি মর্মে বিদ্ধ করে। এগিয়ে চলে উদ্বাস্তু মানুষের মিছিল। কেউ প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি। সবাই উদ্বাস্তু হয়ে বিদায় নিচ্ছে। কেউ কেউ গাধা হয়ে গেছে। গাধা খচ্চরের পিঠে সব বোঝাই করে এগিয়ে চলেছে। আছে ইন্দুর আত্মরক্ষার চেষ্টা। কেই-বা না বাঁচতে চায় ! ইন্দুর স্মৃতিতে ভেসে আসে স্বামী অনন্তের সঙ্গে মিলনের দৃশ্য। কিন্তু স্মৃতিতে তা ঝাপসা। স্মৃতিও সর্বক্ষেত্রে সাড়া দেয় না। স্মৃতিও প্রতারণা করে। বাসর ঘরে অনন্ত ইন্দুকে বলেছিল স্বাধীনতার কথা। কোন স্বাধীনতা ? দেশ না নারী স্বাধীনতা ? কেননা ইন্দুরা জানে দেশ স্বাধীন হলেও নারী স্বাধীন হয় না। মানুষ ভেসে চলে। সঙ্গী শুধু স্মৃতি। কখনও স্মৃতিতেই ভেসে যাওয়া। ইন্দুর মনে হয় এ কোন ধরনের অস্তিত্ব ! কোন প্রকার বেঁচে থাকা। জীবনের শূন্যতা। শুধুই বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখা –

‘’অনন্তের শরীরে তা যতই স্বপ্ন হোক তার রেশ এখনও ক্রিয়াশীল। কিন্তু এখন তো আবার ভাসতে শুরু করেছে, কোথায় ঠাঁই ? কতদূর ভেসে গেলে মানুষ স্বাধীন হয় ? বিয়ের রাতে অনন্ত তাকে স্বাধীনতার কথা বলেছিল, সেই কথাগুলি ঠিক কী ছিল যা এখন মনে করতে চেয়েও বহু চেষ্টাতেও তা পারছে না। যখন সে বুঝ; তার স্মৃতিতে ভেসে যাওয়া ছাড়া অন্য কিছুর অস্তিত্ব নেই। তখন সে শান্ত হয়ে ভাববার চেষ্টা করে- এ কোন্‌ ধারার ভেসে যাওয়া ?’’( তদেব, পৃ. ২৫৯ )

      আছে রূপকথা। যেকোন বিষয়েরই বিবর্তন ঘটে সময়ের ব্যবধানে। সময়ের হাত থেকে কারও নিস্তার নেই। তবে রূপকথাইবা কেন বাদ যায় ! রূপকথা, ছড়ারও বিবর্তন ঘটে যাচ্ছে। ইংরেজ এসে ঈশ্বরের স্থানে যিশুকে প্রতিষ্ঠা করেছে। ধীরে ধীরে ব্যক্তি মানুষের ঈশ্বর চিন্তা পাল্টাচ্ছে। অবিশ্বাস, সংশয় বড় হয়ে উঠছে। ঈশ্বর নিয়ে নানা সন্দেহ দানা বাঁধছে। ক্রিস্তান হয়ে গেছে খ্রিস্টান। ক্রিস্তান শব্দে পর্তুগিজ গন্ধ। এ শব্দে ইংরেজ প্রভাব নেই। শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে গেছে। গুরু মশাই খ্রিস্টানি কায়দায় শিক্ষা দেন। প্রতিদিন পাঠ শুরু হয় মহারানি ভিক্টিরিয়াকে প্রণাম করে। কিন্তু আজ আর প্রণাম নয়। প্রণাম অপেক্ষা আত্মরক্ষার পাঠ বড় হয়ে ওঠে। ব্যাঙা মাস্টার আত্মরক্ষার পাঠ দিতে বাধ্য হন। বোর্ডে উঠে আসে –‘নখ-পথ-ভয়-মন-ক্ষয়-বড়’। ব্যাঙা মাস্টারের ভাবনা হিন্দুস্তান বা পাকিস্তান হলে খ্রিস্টান কোথায় যাবে ? ইংরেজ তো খ্রিস্টানকে নিয়ে যাবে না। ট্রাইবাল ব্যাঙা হাসাদা দুর্ভিক্ষে হয়েছে ব্যাঙা স্যামুয়েল। তবে কিশোরের পিয়ার আলি হওয়া পৃথক। একজন অভাবে অন্যজন বিধর্মীদের ভয়ে। মানুষের জাতি রূপান্তর ঘটে যাচ্ছে। এই ট্রাইবালরা অভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। এবার যাবে কোথায় ? কোনও পরিত্রাণ আছে কি ? উত্তর ধ্বনিত হয় ‘না’। ব্যাঙা হাসাদারা কিন্তু পুরোপুরি পাল্টে যায়নি। যাওয়া কি সম্ভব ? বোধহয় না। লেখক লিখতে বাধ্য হন –

‘’যে ব্যাঙা হাসদা ফাদার লালেমলির ক্যাম্পে গিয়ে এক দুর্ভিক্ষের ঠেলাতে স্যামুয়েল হয়ে যায় আর পাকিস্তানের গুঁতোতে কিশোর যে পিয়ার আলি হবে তাতে সে আশ্চর্য হবার মতন কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। ব্যাঙা স্যামুয়েল শুধু সাইকেলে বসে মাটিতে দু-পা ছুঁয়ে নিজেকে একটি চার চাকার যান বানিয়ে পোশাকের দিকে নজর করে দেখে নেয় পাদরি কোটটার কোনো বোতাম খোলা আছে কিনা ? সদরে এলেই পুরোপুরি পাদরির ড্রেস, অন্যসময় একজন সাঁওতাল যেভাবে থাকে সেভাবে। তবে, রোববারের প্রেয়ারের কথা এখানে আসছে না, সেদিন সে পুরোদস্তুর পাদরি।‘’ ( তদেব,পৃ. ২৬১ )

১৯২৮ সালের দুর্ভিক্ষে ক্যাম্পে তিন ধরনের চিত্র দেখা যায়। কলাপাতার একদিকে খায় হিন্দু, অন্যদিকে খায় মুসলিম। ফাদার লালেমণি খায় থালায়। ব্যাঙা স্যামুয়েলের চিন্তা পাকিস্তানে খ্রিস্টান টিকে থাকবে তো ? সে নিজের কোন প্রতিবিম্ব খুঁজে পায় না। পাওয়া সম্ভব নয়। বিম্ব থাকলে তো প্রতিবিম্ব হবে। কিশোর ছিল কংগ্রেসি করা যুবক। পরিস্থিতি বুঝে মুসলিম হতে বাধ্য হয়েছে। ভবতোষের আত্মচিন্তা ছেলে অনন্ত জেল থেকে ফিরলে কী জবাব দেবেন ? হিন্দুরা হারিয়ে গেল কেন ? চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। তিনি আখ্যানে নানা ইঙ্গিতধর্মী বাক্য লেখেন। সচেতন পাঠককে তা থেকেই আখ্যানের সত্য আবিষ্কার করে নিতে হয়। আসে মাছ কাটার প্রসঙ্গ। ভজুয়া কিছুতেই স্থির করতে পারে না কোথা থেকে খণ্ড শুরু হবে। আসলে দেশভাগের সত্য লুকিয়ে থাকে। ঘরে বসে র‍্যাডক্লিফ মানচিত্র ছিন্ন করেন। মানচিত্র বদলে যায় কলমের আঁচড়ে। কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেন না। মাঝে টুকরো তো করতেই হবে। গোটা মাছ ভাজা যায় না। স্বাধীনতার পরেও শোষণ অব্যাহত থাকবে। শুরু হবে ঔপনিবেশিকতার পকেট সংস্করণ নব্য ঔপনিবেশিকতা। বাড়িতেই বিড়াল থাকে। মাছ দংশন করে। ইংরেজের দালাল হয়ে ওঠে ভারতীয়রা। জীবন মৃত্যুর পাশাপাশি অবস্থান। অনন্তের জন্মের সময়ই ভবতোষের মনে হয়েছিল এতো অন্ধকার কেন ? প্রতীকী অন্ধকার। দেশ ছিন্ন হতে চলেছে। অন্ধকারও যেন নীরব প্রতিবাদের বার্তা ডেকে আনে। গাছে পাখি ডাকে। কিন্তু সুরে মিষ্টতা নেই। সব যেন বিষাদ হয়ে যাচ্ছে। ছিন্ন স্বাধীনতা গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসতে থাকে।

      মানুষ তো স্মৃতি নিয়েই বেঁচে থাকে। তবে অতীত বর্তমান, ভবিষ্যৎ যখন স্মৃতিতে আসে সব এলোমেলো হয়ে যায়। ভবতোষের চেতনায় বিদ্যেশ্বরীর স্থানে আসে ইন্দুমতি। ইন্দু মরতে পারে না। স্মৃতিতে বয়ে বেড়ায়। স্মৃতিতেই জীবিত রাখে। নইলে উপকথা হয় না। চিন্তা হয় না। ভাব হয় না। বিনোদবিহারী রক্ষা করতে চায় মোহরজানকে। অথচ মোহরজানের জন্ম হবে বলেই পিতৃপরিচয়ের ভয়ে সে নূরজাহানকে অস্বীকার করেছিল। মন কোন পথে চলে ? সে হিসাব বিধাতা ছাড়া কেউ জানে না। বিধাতার অত সময় নেই হিসেব রাখার। চিত্রগুপ্তের খাতায় শুধুই শূন্যতা। পুত্রের মুসলিম হওয়া মেনে নিতে পারেনি করুণা মোক্তার। নূরজাহানের অনুপুস্থিততে শূন্য ঘরে হোঁচট খায় বিনোদবিহারী। নিজেই নিজের বিভ্রমে পরে। বিভ্রমের গোলকধাঁধায় ডুবে যায়। আবার পরিত্রাণও পায়। আসলে জীবনই বিভ্রান্ত। জীবনের পরিসর মরীচিকা। ব্যক্তি এই মরীচিকায় বারবার ডুবে যায়। সর্বত্রই কীটের দংশন। চলে আলো-অন্ধকারের খেলা। মৃত্যু না জীবন কোনটা সত্য- বিভ্রান্তি জন্ম দেয়। জীবিত ও মৃত্যু মানুষের মধ্যে ছায়ার পার্থক্য। সর্বত্রই শ্রেণিবিভাজন। শ্রেণির প্রশ্ন বড় হয়ে ওঠে। জমিদার হিন্দু। মসজিদ মুসলিমের। দানপত্রে লেখা আছে গোরু জবাই চলবে না। পিতা করুণা মোক্তারের বিরুদ্ধে পুত্র কিশোর বিদ্রোহ ঘোষণা করে। করুণা মোক্তার দেশ ছাড়া করতে চেয়েছে পুত্রকে। চারিদিকে দাঙ্গার আভাস পাওয়া যায়। পাকিস্তানের সূচনা বিন্দু কোন ইঙ্গিত দিচ্ছে ? পাকিস্তান শব্দের আভিধানিক অর্থ কি যেন ? শান্তি যেন অশান্তির বার্তা নিয়ে উপস্থিত হচ্ছে। ব্যক্তি ডুবে যাচ্ছে রসাতলে। বিনোদ সমস্ত ত্যাগ করেছিল নূরজাহানের জন্য। ধর্ম, সমাজ, সংসার। শুধু ভালোবাসা ! এতো ব্যক্তির বোধ। লেখকের ভাষ্যে-ব্যক্তিগত কাঙ্ক্ষিত বোধই জন্ম দেয় সংকটের। ব্যক্তি ডুবে যায় ভাবনার চোরাবালিতে। সহায়ক হয়ে ওঠে সমাজ –

‘’বিনোদ কাকাকে কাঁদতে দেয়-মানুষটা সংসারই করেনি নূরজাহানের সঙ্গে ! এরা কি শাপগ্রস্ত নারী-পুরুষ ? না, অন্য কোনো এক সভ্যতার প্রকাশ। যদি এই সম্পর্ক থেকে ধর্মের সমস্তরকম ছায়া সরিয়ে নেওয়া হয় –তবে কী কেবল ধ্বনিত হবে শুধু ভালোবাসা, একান্ত ভালোবাসা। এ তো ব্যক্তিগত কাঙ্ক্ষিত এক বোধ-আর এখানেই বুঝি সংকটের বীজ।‘’ (তদেব, পৃ. ২৬৭ )

 ইন্দু স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নে সময়ের ক্ষত আবিষ্কার করে। কিন্তু স্বপ্ন তো স্বপ্নই। আকাশে চাঁদের রাজত্ব, সংসারে পুরুষের। চাঁদের অনুপস্থিত এক অনন্ত শূন্যতা যা পূরণে ব্যর্থ তারারা। সংসারে পুরুষের ক্ষেত্রেও তাই। সাপ দংশন করতে আসে। কিন্তু বাস্তুসাপ তো দংশন করে না। নশ্বর সময়ের যন্ত্রণা বড় হয়ে ওঠে। মোহরজানরা প্রেমের ওপর আস্তা রাখতে পারে না। ঝুটা সময়। ইন্দুরা ভেলা নিয়ে ভেসে যায়। এ ভেলা বেহুলার ভেলা নয়। জীবনের ভেলা। জীবনের সন্ধান জানে। রাতে ভেলা ভাসে। রাত্রি মানেই অন্ধকার। অন্ধকার মানেই বিপদ। সে বিপদ জানে ব্যাঙা, পালোরা। পাল্টে যাচ্ছে ডাকিনীতন্ত্র। পালো, আদরীরা শুকিয়ে যাবে। জনজীবন ক্রমেই কুসংস্কারপূর্ণ লোকাচারে ডুবে যাচ্ছে। আদরীরা নিজেই ঘোষণা করে সে ডাইনি। অবধারিত পরিণাম হয় মৃত্যু। এ বিধান দেয় জানগুরু। ডাইনির মৃত্যু না হলে সমাজের ক্ষতি। ফলে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। জানগুরু বলেছিল চিতা নিভে যাবার আগেই মৌজা ছাড়তে হবে পালোকে। নইলে ডাইনির হাত থেকে রেহাই নেই। ব্যাঙারা মৌজা ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু চিতা জ্বলতেই থাকে। যেন রাবণের চিতা হয়ে যায়। একটি সমাজ ও মানুষ কুসংস্কারে ডুবে গেল। আমরা তো বিজ্ঞানমনস্ক হতে পারিনি।

 উপকথার জন্য নদী না নারী, নাকি জীবন !

             ইন্দু দীর্ঘদিন চিঠি লেখেনি অনন্তকে। সে তো চিঠি লেখাই জানে না। চেষ্টাও করেনি। চিঠি লিখতে বসে পুরাতন চিঠি খোঁজে। চিঠির প্যাটার্নে পুরাতন বাংলা গদ্যের নিদর্শন উঠে আসে। তবে চিঠি লিখতে পারেনি শেষ পর্যন্ত। একবুক শূন্যতা নিয়ে ইন্দু এক দেশ থেকে অন্য দেশে ভেসে যাচ্ছে। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। সব শূন্য। তবুও ভেসে যাওয়া। এও এক নিয়তি। ভালবাসাও যেন এক  পথ চলা। এ পথ সীমাহীন। সবাই চলতে পারে না। ইন্দু শৈশবে ফিরে যায়। ওপার বাংলা জলের দেশ। জলের স্পর্শে যেন আত্মীয় স্পর্শ পাওয়া যায়। দলে দলে মানুষ পালাচ্ছে। মাঠ শুকিয়ে যাচ্ছে। ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখে মনে হয় মেঘ। কিন্তু সব শূন্য। সব রহস্য। মাঠের আগুনের সঙ্গে চিতার আগুন মিলিয়ে যায়। মনে হয় ডাইন। দাবানলে সব পুড়ে যাচ্ছে। সূর্যের প্রখর তেজ। জলের মাছ সব শুকিয়ে যাচ্ছে। দাবানল তো প্রাকৃতিক নিয়মেই বন্ধ হয়। তবু চারিদিকে স্তব্ধতা। মানুষের দুর্দশায় প্রকৃতিও যেন শত্রুর ভূমিকায় অবতীর্ণ। রাষ্ট্রের অনৈতিকতায় মানুষ বুঝেছিল প্রকৃতি বুঝি পাশে দাঁড়াবে। তা হয় না। সম্ভবও নয়। প্রকৃতি নিজের খেয়ালেই মাতোয়ারা –

‘’দাবানল নিজে নিজেই নিভে গিয়েছিল সেদিন। সেই আকাশে দেখা গিয়েছিল আধখানা চাঁদ নেমে আসবার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। নেমেই বা কী দেখবে ? আগুনের দগ্ধ শিশুকে বের করে আনা হবে পৃথিবীর অন্ধকারে ? নীল মৃত্যুর উপর জ্যোৎস্না তো কেবল মাত্র মায়া বিস্তার করবে – চাঁদও তো নিরুপায়, আগামীকালই আত্মসমর্পন করতে হবে আবার। তখন ব্যাঙার মনে অবাক করা প্রশ্ন ছিল-এত খরার পরও মানুষের দেহে এত রক্ত থাকে ?’’ (তদেব, পৃ. ২৭৪ )

চারিদিকে অন্ধকার। অন্ধকার নিজের স্বধর্মে বিরাজ করে কিন্তু এ অন্ধকার ঘন। আলোকেও পরাজিত করে। পরাজিতের মধ্যে ভীষণ আনন্দ পায়। আসে ট্রাইবালদের ধর্ম রূপান্তরের প্রসঙ্গ। আঠারো শতকে ফার্নানডেজের আমলে ক্ষুধার্ত সাঁওতালরা খ্রিস্টানে পরিণত হয়েছিল। উঠে আসে এমিলির জন্ম পরিচয়। পর্তুগিজদের ধর্মান্তরীকরণের প্রসঙ্গ। ফাদার নির্দেশ দেন এমিলিকে বিবাহের। নইলে বংশ ধারা লুপ্ত হয়ে যাবে। ফাদার লালেমণির শক্তি নেই দেশে ফিরে যাবার। পথ হারিয়ে গেছে। দেশভাগকে লেখক বাইবেলের সঙ্গে তুলনা করেন। ধর্মযুদ্ধ-ক্রসেড। দাঙ্গা। ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান – এক্সোডাসের সঙ্গে তুলনা। ক্রশ পুড়ে যাচ্ছে। পতনের শব্দ স্পষ্ট। মোমবাতিকে প্রাচীন বৃক্ষের সঙ্গে তুলনা করেন। যে বৃক্ষের একটি ডাল ছিন্ন করলে আরেকটি ডালের জন্ম হয়। আলো-অন্ধকারের খেলা চলে। মোমবাতির নিচের অন্ধকার স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এমলি জনায় সে ব্যাঙাকে ভালোবাসে। কিন্তু নিজেই বিশ্বাস করতে পারেনি। মনে সংশয়। ব্যাঙার পূর্বপুরুষ সাঁওতাল। এ ইতিবৃত্ত সে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না।ফাদারের মতে সবাই ঈশ্বরের সন্তান। কিন্তু ব্যাঙার কি অত তেজ আছে ? ভালোবাসার মনস্তত্ত্ব বড় হয়ে ওঠে।

         ভাদুড়ি মশাই রাতকানা। জীবনের অপর নাম অসুখ। এখানে নিত্য অসুখের বৃন্দাবন লীলা চলে। সুখের সন্ধান করে নিতে হয়। নিরাময় বলে কিছু নেই। সবই যন্ত্রণার পরিণাম। ভাঙন শুরু হয়েছিল গৌড়েশ্বরের আমল থেকেই। ভাদুড়ি বাড়ির এগারো জন পুরুষ মুসলিম মহিলাদের বিবাহ করেছিল। বিবাহ যেন আগ্রাসনের জন্যই। অন্ধকারের সত্য খুঁজতে হয়। অন্ধকারের আড়ালে লুকিয়ে থাকে সত্যের বীজ। ইঙ্গিত থাকে যৌনতার। যিনি উপলব্ধি করতে পারেন না তিনি ব্যর্থ হন। ভাদুড়ি বংশের ইতিহাস ভবতোষের মনে নেই। মনে হয় সেই শেষ প্রজন্ম। সন্তান অনন্তকে বংশের প্রদীপ হিসেবে ধরে না। ইংরেজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল অনন্ত। পিতা নিজেই ধরিয়ে দেন। মনে হয়েছে কুপুত্র। পুত্রবধু ইন্দুকে সে বংশের অন্তর্গত ধরে না। যে নারী সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম তা ভবতোষের কাছে বাতিল। আসে ঘোড়ার প্রসঙ্গ। চলমানতা। কিন্তু পৃথিবী তো গোল। আখ্যানও চক্রাকারে বিবর্তিত হয়। ঘোড়ার গতিকে অলৌকিক মনে হয়। কেননা অত্যাচারের প্রতীক। ঘোড়া ছুটলেই পরের দিন বকেয়া খাজনা আদায় হত রিকেট সাহেবের। পশুর স্বাধীনতা নেই। মালিক নিয়ন্ত্রণ করে ঘোড়াকে। মহাজন নিয়ন্ত্রণ করে কৃষককে। মহল্লায় কৃষকের মনে হয় সেই বুঝি ঘোড়ার শব্দ প্রথম শুনলো। প্রত্যেকেরই তাই মনে হয়। জাদুবাস্তবতায় সব ভেসে যায়। কিশোর ছিল রিকেট সাহেবের ঘোড়ার সহিস। ঘোড়া নিয়েই সে পাকিস্তান ছাড়তে চেয়েছে। দেশ স্বাধীনতার গতি পেয়েছে। সময় নিয়ে লেখকের বিশেষ কৌতূহল। মানুষের মধ্যে কোন সত্তা কাজ করে –বিস্মরণ না বিশ্বাস ? সময় অনন্ত নয় ! তার বিবিধ রূপ। বিবিধ সত্তা। দখলতন্ত্রের ওপর সময়ের রীতি নির্ভর করে। চলতে থাকে কায়েমিতন্ত্র। সময়কে নিজের করে নিতে হয়। আবার অধিভৌতিক বিন্যাসও আছে। সময় নিজেই সচল। সময়ের জটিল তত্ত্ব কিশোরের ভাবনাকে খণ্ডিত করে দেয় –

‘’ছুটন্ত ঘোড়ার উপর একমাত্র অনন্তই একদিন চড়ে বসেছিল, ঘোড়ার গতিকে নিজের আয়ত্বে এনে উসকে দিয়েছিল ইতিহাসের যুদ্ধের স্মৃতিকে। আসলে অনন্তর ঘোড়াসওয়ার হওয়াটা ছিল সমস্ত চিরায়ত সময়ের উপর দখলদারি। যেন চিরায়ত কোনো ভবিষ্যতের সময় নয়-এমনকি কোনো সুদীর্ঘ সময়ও নয়। সময়ের সঙ্গে চিরায়ত কোনো সম্পর্ক আছে কি না বুঝে উঠতে পারছে না।”( তদেব, পৃ. ২৮১ )

 আছে ফুলের নাম স্মরণ করে রাত্রির সময় নির্ধারণের কৌশল। আখ্যান আমাদের ঐতিহ্যের ভিতর প্রবেশ করে যায়। দিনের হিসেব করা হয় উদিত ছায়া থেকে মধ্যছায়া বিয়োগ করে। আছে পূজার নানা রীতি পদ্ধতি, লোকাচার। যামিনী ঠাকুরের কাছে থাকে পাগলী নামে এক মেয়ে। ঠাকুরের চিন্তা পাকিস্তান হলে পাগলীকে কোথায় রাখবে। দেবীর কাছে চলে পশু বলি। লেখকের ভাষ্য –‘’রক্তের মধ্য দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাওয়া যায় মোক্ষে !’’ ক্ষমতার স্বাদ, স্বাধীনতার স্বাদ। এ স্বাদের জন্য প্রয়োজন রক্তের। কান্তনগরে কোন পতাকা উঠবে এ নিয়ে দ্বিধা- চাঁদ তারা না তেরাঙা। এরমধ্যেই পাগলী পাথর হয়ে যায়। অলৌকিকতা, জাদুবাস্তবতা। যামিনী ঠাকুরের বিশ্বাস পাগলী যখন পাথর হয়ে গেছে তখন কান্তনগরে হিন্দুই থাকবে। পাগলী পাথর হল ! কিন্তু কীভাবে হল ? এ কি দ্বিতীয় বিদ্যেশ্বরী। ধন্দে ভবতোষ। পাগলী হারিয়ে গেলে কোন খোঁজ করেনি যামিনী ঠাকুর। ভবতোষের সংশয়, সন্দেহ। কিন্তু পাথর কিসের ইঙ্গিত ? পাকিস্তান হয়ে গেলে তারা এমনই কি জড় পাথরে পরিণত হবে ? বিনোদবিহারী ভবতোষকে ডেকেছে রায়বাহাদুর বলে। কিন্তু মনে সংশয়, সন্দেহ। আজও রায়বাহাদুর ! সব শেষ হয়ে গেছে। ইতিবৃত্তে কিছু নেই। উদ্বৃত্ত হয়ে গেছে সব।

স্বাধীনতার জন্য বলিদান আবশ্যক, ধর্ষণও !

       মোহরজানরা লুঠ হয়ে যায়। ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। সব বোধ হারিয়ে যাচ্ছে। চিন্তাশূন্য। ভয়ই সব বোধ শূন্য করে দিচ্ছে। রিকেট সাহেবের ঘোড়ার খুড়ের শব্দ, টাঙার শব্দ সব এক হয়ে যায়। কান্তনগরে এখনও হিন্দু আধিপত্য বেশি। তবু রহমান সাহেবের ধারণা কান্তনগর পাকিস্তান হবেই। ঘোড়ার ডানা জেগে ওঠে। লৌকিক বয়ান অলৌকিকে হারিয়ে যায়। জাহেদ পালিয়ে যায় মোহরকে নিয়ে। করুণা মোক্তার ছিল মোহরজানের আকৃষ্ট। পাকিস্তান হয়ে যাচ্ছে ফলে ধারণা মোহরকে বুঝি বাঁচাতে পারবে না। মৌলবীর বয়ানে বেশ্যা কোন মুসলিম নারী হতে পারে না। মুসলিম হিসেবে মোহরকে অস্বীকার করা হয়। সবার দৃষ্টি মৃত সাকিনার প্রতি। জীবিত মোহরকে নিয়ে কারও কোন আগ্রহ নেই। বেশ্যা বলেই কি সকলের চোখে বর্জিত ? অন্ধ মৌলবিবাদ বড় হয়ে ওঠে। দেশভাগের বিপক্ষে ছিল অনুশীলন সমিতি। এ দলে হিন্দু-মুসলিম দুইই ছিল। দেবী কালীর কাছে তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু প্রতিজ্ঞার মন্ত্র নিয়ে বিবাদ ঘটে। বাঙালি মুসলিমের ছিল হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি টান। আসলে সংখ্যাগুরুর প্রভাব। দীর্ঘদিন একসঙ্গে থাকায় পরজাতি প্রীতির জন্ম হয়। মানুষ পালানোর কথা সীমান্ত দিয়ে। অথচ মানুষ দেবী হয়ে যচ্ছে। ভক্ত পালালে দেবী থাকার কথা নয়। ভক্তই ভগবান হয়ে যাচ্ছে, শালগ্রাম শিলায় পরিণত হচ্ছে। জড় মানুষ হয়ে যাচ্ছে। আছে আলে গাজি। অবিনশ্বর মানুষ। একটি ধারণা। আলে গাজিরা বংশানুক্রমিক ভাবে চলে আসছে। ঘটনা না প্রতীক এ নিয়ে ব্যাখ্যা চলতে থাকে। সব বোঝা যায় না। ভারতীয় মিথের মধ্যে লুকিয়ে আছে জাদুবিশ্বাস।

        দৌলত কাজী নিজেও হিন্দুস্থানে যেতে চেয়েছে। এখনও পাকিস্তান হয়নি। অথচ অনবরত পতাকা বানানো চলছে। কিশোর মুসলিম হলেও নামাজ শিক্ষা আয়ত্ত করতে পারেনি। পাকিস্তান না হতেই কিশোর মুসলিম হয়েছে। পরবর্তী পরিণাম কী হবে আমাদের জানা নেই। হিন্দু-মুসলিমের পাশাপাশি অবস্থান। হিন্দু মুসলিম কালচারের বিশেষ কিছু জানে না। দৌলত মিঞার স্ত্রীর সন্দেহ কিশোর পাকিস্তান হবার আগেই মুসলিম হল কেন ? ভয়ই এর কারণ না অন্য কিছু ! পাকিস্তান না হলে কিশোর মুসলিম থাকবে না আবার হিন্দু হয়ে যাবে। দেশভাগে সাধারণ মানুষের কোনো মুনাফা হয়নি। দৌলতরা যেখানেই যাক দর্জির কাজ করে যেতে হবে। কবীর সুমনের গানে পাই –‘যাহা জল তাহা পানি’। কালচার আয়ত্ত করতে তো সময় লাগবে। কিশোর হঠাৎ বলে ফেলে ‘জল’। থাকে সময় নিয়ে লেখকের নিজস্ব বয়ান। পৃথিবীর চন্দ সূর্যের সিস্টেমও নির্দিষ্ট সময়ে হয় না। কখনও পিছিয়ে যায়। আকাশে নিজের স্থান ত্যাগ করতে চায় না। ক্ষমতার অধিকার কেইবা ছাড়তে চায় ! বিনোদবিহারীর রেডিও নিয়ে গেছে মিলিটারিরা। কোন খবর নেই। চারিদিক সম্প্রচার বন্ধ। থইথই অবস্থা। করুণা মোক্তার সাকিনার হত্যার জন্য কেস করতে গেছে। থানা কেস নেয়নি। কেননা মুসলিমের বিরুদ্ধে কোন কেস নেওয়া যাবে না। সময় রহস্য বড় হয়ে ওঠে। আইন বেআইন হয়ে যাচ্ছে। পুলিস বেঁচে থাকতে নিজেও এক পক্ষ নেয়। নিতে বাধ্য হয়। আইন অপেক্ষা আত্মরক্ষা প্রধান। আইনের চোখে মুসলিম বেশ্যার কোন মূল্য নেই। কান্তনগর ছিল ভবতোষ ভাদুড়ির। তিনি কিছু এলাকা ব্রিটিশকে দিয়েছিলেন শহর করবার জন্য। অথচ পাকিস্তান হয়ে গেলে কিছুই থাকবে না। বটগাছের তলায় ছিল বিদ্যেশ্বরী। পাকিস্তান হলে তিনি কি থাকবেন ? না আগেই বিদায় নিয়েছেন। সব অলীক হয়ে যাচ্ছে। মন্দিরে তো দেবী ছিল না। তাকে কল্পনায় আনতে হয়। ভবতোষ ভাদুড়ির সব চিন্তা তালগোল পাকিয়ে যায়। মৃত সাকিনা জাদুবাস্তবতায় কথা বলে। জীবন জিজ্ঞাসায় উপনীত হয়। দেশ কালের ভূত ভবিষ্যৎ জানতে চায়। সাকিনাদের কোন গতি হয় না। এ নারী যেন ভোগের, ভাগের নয়। কেউ ভাগ নিতে চায় না। মুসলিম বেশ্যার লাশ স্পর্শ করবে না পুলিস। রহমানের আত্মচিন্তা তবে কান্তনগর কি হিন্দুস্থান হচ্ছে ? ধর্মের চৌহদ্দিতে বলি হয় নারী। শুধু কান্তনগরে নয় গোটা ভারতবর্ষেই।

          সরলার ছিল নদীর প্রতি টান। কেন টান ? নদীপ্রবাহের সঙ্গে জুড়ে আছে জনজীবন, ভাষা সংস্কৃতি। নদী নারী একাকার হয়ে যায়। একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠে। পুরুষ যেমন নারীকে নিজের আয়ত্তে রাখতে চায়, স্বাধীনতা হরণ করতে চায় তখনই নদীর স্বাধীনতা খর্ব হয়। স্বাধীনতা মানেই যুদ্ধ। দেবতারা যুদ্ধ করত নারী উদ্ধারের জন্য। নারী-নদীকে লেখক মিলিয়ে দেন। জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে থাকে মৃত্যু। প্রতিমুহূর্তে যেন মৃত্যুর রহস্য মানুষকে নাচিয়ে চলছে। অথচ মৃত্যুকে উপেক্ষা করেই মানুষকে বাঁচতে হয়, স্বপ্ন দেখতে হয়। যিনি পারেন না তিনি পরাজিত। নদীর দুই তীর বড় রহস্যময়. অস্পষ্ট। নিত্য চলে ভাঙাগড়ার খেলা। একে অপরের প্রতি হিংসা, দ্বন্দ্ব। অপর পার ভাঙায় এপারের ভীষণ আনন্দ। জন্ম-মৃত্যুও যেন তাই। একে অপরকে পরাজিত করতে চায় প্রতি মুহূর্তে। সরলাসুন্দরীরা সে রহস্য খুঁজে চলে। ঘোড়ারা নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। এ লৌকিক না অলৌকিক। কিশোর চিনতে পারেনি সহিসকে। মনে হয়েছে গাছ। আসলে মানুষ। বিভ্রম। এ বিভ্রমই জন্ম দেয় বাস্তবতার। যাকে আমরা বলতে পারি কুহক বাস্তবতা। আমজাদ আলি চেষ্টা করে ধাসরহাটকে যেন পাকিস্তানে রেখে দেওয়া হয়। পাকিস্তান হলে এম.এল.এ হবে রহমান চৌধুরী। তবে পতাকা একাই তুলেছেন আতাউল্লা সাহেব। পাকিস্তান হলে রহমানের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। মনে সন্দেহের জন্ম হয়। রহমানের কাছে থাকতে চায় এস.ডি.ও আতাউল্লা সাহেব। সম্মান দেন। নিজের পিঠ বাঁচানোর চেষ্টা করেন। সাকিনার দেহ আছে নদীতীরে লাশকাটা ঘরে। সাকিনার লাশের পাশে ছিল পিয়ার আলি। মৌলবির জীবন থেকে সাকিনা অধ্যায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। মৃত্যুই যেন শেষের অবধারিত পরিণাম। প্রশ্ন হল লেখক মৃত্যুকে নদীতীরে নিয়ে এলেন কেন। নদীর বহমান স্রোতের সঙ্গে রয়েছে মৃত্যুর দোলাচলতা। স্রোতে যেন কোন জীবন নেই। শুধুই মৃত্যুর রণতরী ভেসে যাওয়া। এক নিবিড় শূন্যতা। শূন্যতায় ভেসে যাচ্ছে সব। কিশোর হিন্দু অবস্থায় দাড়ি কামিয়েছিল। এখন দাড়ি আছে। ফলে আগের ছায়া সব হারিয়ে গেছে। নিজের প্রতিবিম্ব হারিয়েছে। বিম্বই কি ঠিক আছে ? সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। এইসব চিন্তার মধ্যে আলো মিলিয়ে যায়। পোকারা মিলিয়ে দেয়। অন্ধকার বিরাজ করে। কিশোর আজ আত্মদর্শনের মুখোমুখি হয়। মৃত্যুই এ দর্শনের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। কেন সে মুসলিম হল ! উত্তর আসে মৃত সাকিনার কাছ থেকে –‘জীবন ছিল আমাদের মধ্যে’। পাখিরা ডানা ঝাপটায়। আলোর সন্ধান পায়। কিশোর জীবনের রহস্য খুঁজে পায়। সব স্বপ্নাচ্ছন্ন মনে হয়। আসলে সে নিজেই তন্দ্রাচ্ছন্ন। কিন্তু ঘুম আসে না। মস্তিষ্কে শত কীট দংশন করলে ঘুম আসবে কীভাবে ? খোলা চোখেই ঘুমায়। ভাগ্যকে লেখক হেড-টেলের মাধ্যমে বিচার করেন। মুদ্রা যখন উপরে তখন বিচার শূন্য। ভাগ্য শূন্য। পড়লেই জয় পরাজয়। সময়ের বুকে আঘাত করেন। মুদ্রা যে সময়ে শূন্য তখন ভাগ্য কোন পক্ষেই না নিরপেক্ষ। দেশভাগ যেন এই পতনের শব্দ। মানুষগুলিকে নিয়ে যেন বাজি খেলা হল। জুয়াখেলা হল। কেউ কেউ মুনাফা লুটল।

কোন পথে এল স্বাধীনতা....

           র‍্যাডক্লিফের গুরুত্ব দেওয়ার কথা ১৯৪১ সালের লোকগণনাকে। সে হিসেবে কান্তনগর পাকিস্তান হয় না। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু। কিন্তু জোর যার মুল্লুক তার। মাতাল শ্যামাপদ গাল দেয় কংগ্রেস ও লীগকে। দুই সংগঠনই মানুষকে নাচিয়েছিল। হিন্দু-মুসলিমের বিভেদ সৃষ্টি করেছিল। মানুষকে নিয়ে খেলছে। মানুষের প্রাপ্য শূন্য। মাটি দোলে না। মাটির কোন কম্পন নেই। অথচ মানুষের কম্পন আছে, ঔদ্ধত্য আছে। বাতাসে মৃত লাশের গন্ধ ভেসে আসে। লাশের কোন নিস্তার হয়নি। এই কি স্বাধীনতা আমরা চেয়েছিলাম ? দেশভাগ হলই। কেউ রক্ষা করতে পারল না। তবে এতো লড়াই কিসের ? সব ভোগাস। জণগনকে নিয়ে দুই রাজনৈতিক দল খেলতে চাইল। খেলায় জিতেও গেল। তবে এতো প্রাণদান, আত্মবলিদান কেন ? চারুদাসীদের কোন দেশ নেই। না হিন্দুস্থান না পাকিস্তান। অথচ দুই দেশের মানুষই ভোগ করেছে। দেশভাগে নারী ক্ষত হল। সবচেয়ে বেশি অত্যাচারিত হতে হয়েছে নারীদের। সব স্বপ্ন শেষ। বিভেদের বীজ মাথা তুলে উঠেছে। নয়া উপনিবেশে শুরু হবে নতুন খেলা। ধর্ষণ তো আছেই সঙ্গে নারী লুণ্ঠন। নতুন ইতিহাস। মানুষের গোত্রান্তর, স্থানান্তর ঘটে যাচ্ছে। সমস্ত দিন ধরে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলি বৃহত্তর সময়ের অংশ। সময়ের ক্রমিক ঘটনাগুলি সাজিয়েই বৃহত্তর হয়ে ওঠে। বৃহৎ সময় যেন ঘাপটি মেরে বসে থাকে। তার নড়চড় নেই। যেন ঘড়ির কাঁটা। তবে বৃহৎ ক্ষত সেই নিয়ে আসে। যা পাবলিক বোঝে না। সক্রিয় থাকে আতাউল্লা। কান্তনগর যারই হোক তাঁর প্রমোশন হবেই। ব্যক্তি কীভাবে প্রশাসনের কাছে নিজের প্রমোশন হাতিয়ে নেয়। সমষ্টির স্বার্থ চরিতার্থ করে, নিজের স্বার্থ তো আছেই। প্রশাসনের দুই কর্তা এস.ডি.ও আতাউল্লা ও দারগা যোগেন। একজন মুসলিম অন্যজন হিন্দু। দুজন দুই পক্ষ নিয়েছে, বলা ভালো আত্মপক্ষ। প্রশাসন নিরপেক্ষতা বজায় রাখেনি। একে অপরকে দোষারোপ করেছে। আছে সোমেশ মাস্টার। তিনি ইতিহাস জানেন। কান্তনগরের ইতিবৃত্ত জানেন। তিনি কান্তনগরকে হিন্দুস্থানেই রাখতে চান। তাঁর স্ত্রী প্রসব যন্ত্রণায় কাতর হলে মিস সরকারকে পৌঁছে দিয়েছে রহমান। এই রহমানরা কিন্তু পুরোপুরি সাম্প্রদায়িক নয়। কেননা তিনি তো মানুল্লা মণ্ডলের ‘কান্তনামা’ পুঁথি শুনেছেন। যা থেকে সোমেশ মাস্টার ‘সেকুলারিজম’ এর ধারণা গড়ে দিয়েছিলেন। আসলে চেতনায় এসেছিল পাকিস্তান। স্বভূমির স্বাদ। তা ঠিক না ভুল তা বোঝার চেষ্টা করেনি। রহমান সাহেবের মেজবিবি অনবরত পতাকায় অর্ধ চাঁদ সেলাই করে যাচ্ছে। হাতে সুচ ফুটে রক্ত বের হয়। কোন প্রশ্ন তোলে না। হতাশা বা বেদনা বোধ নেই। পাকিস্তানের জন্মই যেন রক্তের মধ্য দিয়েই। সব দেশেরই জন্ম বা স্বাধীনতা রক্তের মধ্য দিয়ে। শোষকের বড় স্বাদ রক্তে। সাকিনার লাশ নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে। দোষ দেওয়া হয় হিন্দুদের। এভাবেই সৃষ্টি হয় দাঙ্গা।

        আকাশের তারাদের আলো একই হলেও অভিসন্ধি যেমন ভিন্ন ভিন্ন মানুষেরও তেমন। পাকাফল ক্রমাগত চাপে যেমন ফেটে যায় তেমনি সময় হলে মাতৃগর্ভ থেকে শিশু জন্ম নিতে বাধ্য হয়। লেখকের বয়ানে আকাশের তারা যেন মৃত মানুষের বাসভূমি। পৃথিবীর সৃষ্টি জল থেকে। তেমনি শিশু মাতৃগর্ভে জলের মধ্যেই থাকে। জল থেকেই জীবের সৃষ্টি হয়। আসে তেভাগা আন্দোলনের প্রসঙ্গ। তেইশ জন শহীদ হয়েছেন। ঘুমের আগে প্রতিটি মানুষের চোখে জল ভেসে ওঠে। সে বোধ ঘুম থেকে উঠলে ধ্বংস হয়ে যায়। সাকিনার মৃত কবরে উলঙ্গ হয়ে নেমে যায় মৌলবি। মৌলবির এই আচরণ ভালোবাসা না অন্য কিছু ? অবদমিত যৌনতা কিছুক্ষণ পরেই জানান দেয় সাকিনার লাশ উঠে গেছে। নারী যেন খাদ্য। মৃতেরও যেন শান্তি নেই। মৃত সাকিনার লাশ নিয়ে নোংরামি চরমে ওঠে। দুটি পা শিয়ালে খেয়ে নেয়। মানবসভ্যতার হিংস্র পশুদের হাত থেকে নারীদের মুক্তি নেই। জাহেদ মৃত সাকিনার সঙ্গে কথা বলে। দারোগা যোগেন কোন পদক্ষেপ নেয় না। শুধু নির্দেশ দেয় নতুন শিয়াল যেন না খায়। মৃত নারীর ওপর চলছে ভয়ংকর অত্যাচার। এইভাবে জন্ম নেয় নতুন দেশের। যোগেনের কাছে ‘নোশানাল’ এর অর্থ সিদ্ধান্তহীনতা। ফলে সে কোন অর্ডার মানতেও পারে আবার নাও মানতে পারে। নিজের বিবেক অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছে। আসলে মুসলিম বলেই দায়িত্ব চাপিয়ে দিচ্ছে এস.ডি.ও সাহেবের ওপর।

         র‍্যাডক্লিফের নির্দেশ এখনও আসেনি। মুসলিমরা পতাকা তুলেছে। হিন্দুরাও যেকোন মুহূর্তে তুলতে পারে। আতাউল্লার ভয় হিন্দুরা পতাকা তুলল কিনা ! মিস সরকারের চিন্তা অর্ধদগ্ধ ফার্নানডেজকে নিয়ে কোথায় যাবে। দেশভাগ হবে নিশ্চিত। এখানে আর কি থাকা যাবে ? এ যেন এক লড়াই। নিশ্চিত বিদায় নিতে হবে। কিন্তু কোথায় ? অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। নদীর চোরাস্রোত বয়ে যায়। এক বিপর্যস্ত সময়। মানুষ কোন পারে যাবে হিসেবে নেই। মাঝ নদীতে যাত্রীবাহী নৌকা। মানুষের ভাগ্য র‍্যাডক্লিফের হাতে। ব্যাঙা সাঁওতাল বলেই মিস সরকার নিজের ভালোবাসা অস্বীকার করেছিল। কৃষ্ণবর্ণের সন্তান বলেই ভালোবাসা মুছে দিয়েছিল। অন্ধকার তো রাতের ইঙ্গিত। কিন্তু অন্ধকারের মধ্যেই থাকে আলোর দিশা। নব সূর্যদয়ের আভাস। মিস সরকারের আর পালাবার জায়গা নেই। একটা মানুষ আর কত লড়াই করবে ? এবার সে ধরা দিতে চায়। বন্ধন গড়ে তুলতে চায়। বিশ্রাম চায়। পরিত্রাণহীন পথই যেন তাকে স্যামুয়েলের উপলব্ধিতে নিয়ে যায়। গাছের ঘুম আজ সে বুঝতে পারে। চিন্তা পরিপূর্ণ পায়। জীবনের ব্যাখ্যা বুঝতে পারে। মনে শান্তি পায়। জাহেদকে আজ কবর দেওয়া হবে। মিঞা কবর নিয়ে এবার আর ভুল করেনি। বলা ভালো ভুল করতে দেওয়া হয়নি। গাছের জন্মবৃত্তান্ত নেই। ফলে লেখক অলৌকক জগতে যেতে পারেন। এ গাছ বাজপিরের আবাসস্থল। জীবন অন্তহীন। তবে ক্ষয় আছে গাছের মতো। যোগেন হিন্দু বলেই গাছের ছালে হাত দেয়নি। হাত না দিয়ে নিজে বেঁচে থাকতে চান। জীবনের ক্ষীণবাতাস উপভোগ করতে চান। জীবন চলিষ্ণু। অনন্ত মুক্তি পায়। স্বাধীনতার কথা শুনেছে কিন্তু পার্টিশনের কথা শোনেনি। কান্তনগর এখনও ‘নোশানাল এরিয়া’। খবরের কাগজে দেশ স্বাধীন হবার কথা প্রকাশিত হয়েছে। নদীর অবস্থান নিয়ে অনন্তর জিজ্ঞাসা বড় হয়ে ওঠে। বর্ষায় নদী বহু প্রসারিত। তবে নদী কোনদিকে ? অনন্ত ‘Dominion’ এর অর্থ করেছে ‘স্বায়ত্বশাসিত উপনিবেশ’। সত্যিই তো উপনিবেশ। স্বাধীন উপনিবেশ। এ উপনিবেশেও অত্যাচার চলবে। কিন্তু সে অত্যাচার চলবে সিস্টেম অনুসারে।

        যাবতীয় সমস্যার অবসান হয়। কান্তনগর ভারতেই পরে। সবাই অনন্তকে কলকাতায় রেখে চলে গেছে। ঘুম থেকে উঠে দেখে দেশভাগ হয়ে গেছে। অনন্তর চিন্তা কোন বক্তব্য রাখবে ইন্দুর কাছে। ব্যর্থ হয়ে যায় অনন্তদের স্বপ্ন। ইন্দুকে কী করে বোঝাবে দেশভাগের সঙ্গে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। ইন্দুরা ভেসে যায় জনস্পর্শহীন পথ দিয়ে। এ নদীর ভূগোল জানেনা রামভাসা। এক অসীম দূরত্ব। এ পথের শেষ নেই। পথের হিসেব নেই। আছে শুধু জীবনের গতি খোঁজা। জীবনের সম্পূর্ণতা কোথায় ? এ সম্পূর্ণতার জন্য কত পথ হাঁটতে হবে ! শুধুই কি হাঁটা ? একা নিসঙ্গ ইন্দু। একাকিত্বের মধ্য দিয়েই বুঝি ব্যক্তি মানুষ স্বাধীন হয়। ইন্দুর নিরুদ্দেশ হওয়ার মধ্য দিয়েই লেখক দেশভাগের সত্য আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন। ইন্দুর এই ভেসে চলা অনিশ্চিত। অনিশ্চয় চলার মধ্যেই জেগে থাকে জীবনের স্বপ্ন, বেঁচে থাকার স্বপ্ন। কান্তনগরে শুরু হয়ে যায় স্বাধীনতার উৎসব। ভবতোষ ভাদুড়ি আনন্দিত। কিন্তু তাকে পরিত্যাগ করতে হয় ‘রায়বাহাদুর’ উপাধি। বিদ্যেশ্বরী মন্দিরে প্রদীপ জ্বলে। বিদ্যেশ্বরীরা টিকে থাকে। লেখক ব্যক্তি স্বাধীনতার সঙ্গে দেশের স্বাধীনতাকে মিলিয়ে দেন। ব্যক্তিজীবন, সমাজজীবন সহ রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটে যায়।

           লেখক মুন্সিয়ানার সঙ্গে এ আখ্যান গড়ে তুলেছেন। মানুষগুলি নিরুদ্দেশ হল। চরিত্রগুলির অবধারিত পরিণাম আমরা জানলাম না। মিস সরকাররা কোথায় গেল ? কান্তনগর হিন্দুস্থান বলেই হয়ত সে বয়ানের প্রয়োজন হয়নি। উপকথা, বাস্তব-অবাস্তবের দোলা, কুহকের বাস্তবতায় তিনি আখ্যানকে দুলিয়েছেন। তাঁর আখ্যান সরল রেখায় চলে না। পথ বহু জটিল। বিবিধ পথ। কিন্তু মিলনস্থল এক বিন্দুতে। সে বিন্দুতে এসে উপনীত হয় অনন্ত ভবতোষরা। এক জটিলতায় তিনি ভ্রমণ করেন। নিজেই আখ্যানকে ভেঙে দেন। ছিন্ন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নিয়ে এগিয়ে চলেন। ফলে বহু চরিত্র এসে উপস্থিত হয়। আবার হারিয়েও যায়। আসলে তিনি নিরুদ্দেশ করে দেন। তিনি তো উপকথা লিখতে চান। কিন্তু এ উপকথা হাজার বছর ধরে একটু একটু করে গড়ে ওঠেনি। এ ব্যক্তি লেখকের উপকথা। তাই কার্যকারণ সম্পর্ক এসে উপস্থিত হয়। অনন্ত, ইন্দুরা রাষ্ট্র সময় সম্পর্কে ভয়ংকর জিজ্ঞাসা উপস্থিত করেন। সে জিজ্ঞাসার উত্তর খোঁজেন। আখ্যান গড়েন।

18 মন্তব্য
প্রদর্শন
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সর্বাধিক পাঠকের পছন্দ

1661256490.jpg
কবিতাঃ রহিত ঘোষাল

কবিতা

এমন একটা জায়গা যেখান থেকে শহর বিদায় নিয়েছে, বসন্ত দুপুর এসেছে,চারিদিকে ধুলো মাখা
আগে পড়ুন...
1714852263.jpg
আমার জানতে খুব সাধ জাগে

গোলাম কবির

কবিতা

যেদিন আমি থাকবো না - সেদিন কী তোমার আকাশ জুড়ে পোয়াতি মেঘেরা খেলা করবে সারাদিন !
আগে পড়ুন...
1602146528.jpg
বৈশাখ

সুধাংশুরঞ্জন সাহা

কবিতা

রোদে আগুনের দাউদাউ । বাতাসে গাছহীন পুকুরহীন ছায়াহীন তীব্র হাহাকার
আগে পড়ুন...
1695994358.jpg
আঁচল

শাশ্বত বোস

গল্প

“তুর গতর টোয় আর আগের মত মজ নাই রে, দিখলে খিদা লাগেক লাই বটে|” ডগরের দড়ি
আগে পড়ুন...
1714932366.jpg
রাতের সমান

প্রবীর কোনার

কবিতা

এরপর দিগন্ত । আলো কমে আসছে দেখে সব পথ মিলিয়ে যেতে যেতে রাতের সমান ।
আগে পড়ুন...
1714933362.jpg
প্রেম নদী কথা

গৌরী বিশ্বাস মৌ

কবিতা

তুমি আমার ইছামতি বহ মানতা উজান বেয়ে চলেছ বৈরাগী পাড় ভেঙ্গে ও আমার ইচ্ছে নদী ,যাই যদি সীমানা ডিঙিয়ে
আগে পড়ুন...
1688388047.jpg
করতল

সুতপা দেবনাথ

কবিতা

অবিশ্বাসী মন হাত বাড়িয়ে রাখিজ্যোতিষ সম্রাটের কাছে ।রেখা খুঁটিনাটি,আরো কি কি সব আছে
আগে পড়ুন...
1602886502.jpg
কবিতাঃ মলয় মজুমদার

কবিতা

অনেকগুলো আলো । বিবর্তমান । কিছু কিশোরীর সাথে বয়স্ক ছাত্র । বিদ্যুতের রঙ । আকাশে তারার মতো ধাতু ধর্ম কি ? অথবা মানুষের
আগে পড়ুন...

সর্বাধিক দেখা

1715172125.jpg
অথ রাজাধিরাজ রাজবৈদ্য সংবাদ((একগুচ্ছ কাল্পনিক সংলাপ))

সুদীপ দাশ

রম্যরচনা

আজকের বিশ্বের যিনি ভাগ্যনিয়ন্তা  সেই যুক্তরাষ্ট্র নামক দেশটির রাজাধিরাজ এবং অশীতিপর রাজবৈদ্যের বাকযুদ্ধ জমে উঠেছিল করোনা আবহে ২০২০সালের গোড়ায় ।
আগে পড়ুন...
1688388047.jpg
করতল

সুতপা দেবনাথ

কবিতা

অবিশ্বাসী মন হাত বাড়িয়ে রাখিজ্যোতিষ সম্রাটের কাছে ।রেখা খুঁটিনাটি,আরো কি কি সব আছে
আগে পড়ুন...
1661256490.jpg
কবিতাঃ রহিত ঘোষাল

কবিতা

এমন একটা জায়গা যেখান থেকে শহর বিদায় নিয়েছে, বসন্ত দুপুর এসেছে,চারিদিকে ধুলো মাখা
আগে পড়ুন...
1714852263.jpg
আমার জানতে খুব সাধ জাগে

গোলাম কবির

কবিতা

যেদিন আমি থাকবো না - সেদিন কী তোমার আকাশ জুড়ে পোয়াতি মেঘেরা খেলা করবে সারাদিন !
আগে পড়ুন...
1671876495.jpg
এলোমেলো স্মৃতি

অর্পিতা দাস

কবিতা

ঢিল ছোড়া দূরত্বে আমরা বন্ধনীর কার্যকলাপ ক্রমশ জটিল হল । উত্তরণ চেয়েছিলাম একক চাঁদের বাড়ি
আগে পড়ুন...
1596813379.jpg
এক বিকেলের কথন

দেবলীনা দে

কবিতা

একটা মেঘভাঙা বিকেল খুঁজি শেষবেলায়দু-চার ফোঁটা বৃষ্টি যখন ক্ষনিকের দেখা
আগে পড়ুন...
1714932366.jpg
রাতের সমান

প্রবীর কোনার

কবিতা

এরপর দিগন্ত । আলো কমে আসছে দেখে সব পথ মিলিয়ে যেতে যেতে রাতের সমান ।
আগে পড়ুন...
1661160096.jpg
ঈশ্বরীয় শুক্র বীজের ঋষি দানব কথা ও অপ্সরার গমন বৃত্তান্ত

নিমাই জানা

কবিতা

পরমহংস বীজের মতোই ছোপ ছোপ মহা ঋষি শুক্র বীজ । অব্যয় বীজ । ছেঁড়া ধুতিতে
আগে পড়ুন...